বসন্তের জন্য অপেক্ষা

Image
  প্রিয় ঋতু কি কেউ জিজ্ঞেস করলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়বো। কোনটা প্রিয় ঋতু? সবগুলোই যে প্রিয়! আমার বর্তমান ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম অঙ্গরাজ্য ডেলওয়্যার।এই ডেলওয়্যারে প্রতিটা মৌসুম ভিন্নতা নিয়ে আসে। যেহেতু এখানে প্রতিটা ঋতুর একটা   স্বতন্ত্র অস্তিত্ব  আছে তাই তাদের প্রতি আমার পৃথক পৃথক ভালোবাসা জন্মে গেছে। প্রতিটা ঋতুই নিয়ে আসে অনন্য আমেজ, প্রকৃতি সাজে অনুপম সাজে। সেই সাজ  যেন অন্য ঋতুগুলোর চেয়ে একেবারে ভিন্ন। এই যেমন এখন গুটিগুটি পায়ে এসেছে ঋতুরানী বসন্ত: আকাশে-বাতাসে ঝঙ্কৃত হচ্ছে তার আগমনী সুর, আমি সেই সুর শুনতে পাই।  সবগুলো ঋতু প্রিয় হলেও নিজেকে শীতকালের বড় ভক্ত বলে দাবী করতে পারিনা। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে যার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, তার পক্ষে ঠান্ডা আবহাওয়াতে মানিয়ে নেওয়া কার্যত কষ্টকর, বিশেষত সেই শীতকাল যদি চার-পাঁচ মাস স্থায়ী হয়। তাই শীতকাল বিদায় নিয়ে যখন বসন্তকাল আবির্ভূত হয় তখন এক একদিন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবি, "এত্ত সুন্দর একটা দিন দেখার সৌভাগ্য হলো আমার!" শোবার ঘরের জানলা দিয়ে প্রভাতের বাসন্তী রঙের রোদ এসে ভাসিয়ে দেয় কাঠের মেঝে, সাদা আরামকে

রমজান - স্বদেশে বনাম প্রবাসে

   রান্নাঘরে উঁকি দিলে ভেসে আসে ফুটন্ত তেলে পেঁয়াজু-বেগুনী ভাজার শব্দ। বাতাসে উড়ে বেড়ায় হলুদ-মরিচ-ধনেপাতা-ডাল-বেসন মিশ্রিত এক ধরণের পোড়া-পোড়া মুখরোচক ঘ্রাণ। পেঁয়াজু, বেগুনীর সাথে এক একদিন যোগ হয় আলুনী, কপিনী (ফুলকপি বেসন মেখে ভাজা) কিংবা মুরগীর কিমা দিয়ে তৈরি আলুর চপ। বড় সাদা কাচের বাটিতে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, সরিষার তেল সহযোগে মাখা হচ্ছে মুড়ি। বুট ইতিমধ্যে চুলা থেকে নেমেছে। তৈরি হয়ে আছে জগ ভর্তি লেবু কিংবা তেঁতুলের শরবত, তাতে ভাসছে বরফের স্বচ্ছ টুকরো। 



এখন বাবার জন্য অপেক্ষা - হয়তো অফিস থেকে ফেরার পথে আনবেন জিলাপি, হালিম কিংবা সুতলি কাবাব। আমার যতদূর মনে পড়ে বাবাকে কখনও সুতলি কাবাব ছাড়া অন্য কোন কাবাব রমজান মাসে আনতে দেখিনি! রোজার মাস ছাড়া সুতলি কাবাব আমাদের খাওয়াও হতো না। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই কাবাব কখনো খেয়ে না থাকলে অবশ্যই খেয়ে দেখবেন - পরোটার সাথে খেতে দারুণ সুস্বাদু। 


খাওয়া-দাওয়া দিয়ে শুরু করলাম কারণ রমজান মাসে আমাদের খাবারে একটা ভিন্নতা আসে। রোজা রাখার আনন্দটা বৃদ্ধি পায় ইফতারে কি খাব তাই ভেবে! ছোটবেলায় ইফতারের বিশেষ খাবারগুলি বছরের বাকি সময় বলতে গেলে খাওয়াই হতো না। 


দেড় দশকের প্রবাসী এই আমি এখন অবশ্য বছরের অন্যান্য সময়েও পেঁয়াজু বানাই - বিশেষত যখন নস্টালজিয়া জেঁকে বসে। বাড়ীর পিছনের বাগানে গ্রীষ্মে যখন সবজি চাষ করি তখন নিজের লালিত গাছে ফলিত বেগুন দিয়ে কোনো বিকেলে তৈরি করি বেগুনী। মুড়িও মাখানো হয় মাঝেমাঝে - এমনও দিন আসে যখন হাতের কাছে যা আছে তার সবকিছুতেই অরুচি - বারবার মনে হয় যদি এক প্লেট চটপটি বা ফুচকা কিংবা নান-কাবাব কেউ জাদুবলে এনে দিত! অমন দিনগুলিতে ঘরে ঝাঁকানো ঝালমুড়িতেই আমি ওই প্রিয় খাদ্যগুলির সাধ মিটাই।


যা বলছিলাম, এই প্রবাস জীবনে ছোটবেলার বা ঢাকার সেই রমজান মাসের আমেজ পাইনা। বাতাসে ভেসে আসেনা পেঁয়াজু-বেগুনী ভাজার গন্ধ, টেবিলে ‘ইফতার প্লেট’ সাজিয়ে কেউ বলেনা, "তাড়াতাড়ি! আর মাত্র দশ মিনিট বাকি!"


প্রবাসে বাবারা হাতে করে নিয়ে আসেনা সুতলি কাবাব কিংবা মুচমুচে জিলাপি। দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেকেই জানেনা যৌথ পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাগরিবের আযানের জন্য অপেক্ষা করা কাকে বলে। জানেনা এক সাথে একই সময়ে রোজা "খোলা" কতটা আনন্দের। 


ঢাকায় রমজানের ভোরে ঘুম ভাঙতো মসজিদের মাইকে করা সেহরি খাওয়ার আহ্বানে অথবা মা-বাবার ডাকে। এখানে ডেকে তোলে মুঠোফোনের এ্যালার্ম। ফজরের আযান শুনতে চাইলে চালিয়ে দিতে পারেন মুঠোফোনে আযান অ্যাপ। একটি রেকর্ডকৃত কণ্ঠ আপনাকে শুনিয়ে দিবে আযান, কিন্তু তাতে সরাসরি শোনার আমেজ নেই। 


রোমে অবস্থান করলে রোমানের মতন আচরণ করো - এই কথাটির মতন রমজান মাস নিজেদের জন্য সহজ করার চেষ্টায় এই সুদূর আমেরিকাতে আমরা বেগুনী-পেঁয়াজু শুধু ছুটির দিনে বানানোর চেষ্টা করি! এক সপ্তাহের বুট একবারে তৈরি করে ফ্রিজে রেখে দিই! প্রতিদিন টাটকা তৈরি করার সময় বা শক্তি কোথায়? নানা রকম ফল, সেদ্ধ সবজি, ডিম, হিমায়িত ফালাফেল, কিব্বেহ, মোমো অথবা অন্য কোন হিমায়িত নাশতা, ঘরে তৈরি স্যানউইচ ইত্যাদি দিয়ে সেরে নেয়া হয় ইফতার। হালিম খেতে চাইলে রাঁধুনির হালিম মিক্সই আমাদের ভরসা। জিলাপি? সেও বাক্সবন্দী পাওয়া যায় কিন্তু স্বাদ যে টাটকা জিলাপির মতন নয় সেটা বলে দিতে হয়না। 


গৃহাকুলতা কি তা এই পবিত্র রমজান মাসে এবং তার সমাপ্তির পর আনন্দময় ঈদুল ফিতরে এই হৃদয়ের প্রতিটি কোণে অনুভূত হয়। দেশ ছেড়ে শুধু দেশই ছাড়েনা মানুষ, অগুনতি ভালোবাসার মানুষ, মুহূর্ত, উৎসব ও আরও কত কীই না ছেড়ে আসে তারা। লেপের নীচে মার্চ মাসের হালকা ঠান্ডায় তারা রোমন্থন তারা ফেলে আসা জীবনের সুখস্মৃতি - শৈশব, কৈশোর, যৌবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলি। 


প্রবাসে না এলে হয়তো হৃদয়ঙ্গম করতে দেরী হতো - এই জীবনের আপাতদৃষ্টিতে ছোট বিষয়গুলিই আসলে বড় বিষয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যত সময় কাটছে ততই বেশি বেশি উপলব্ধি করছি। তাই পরিবার-পরিজন পরিবৃত একটি স্মরণীয় রমজান মাস কাটুক সবার এই কামনাই করি। 

Comments

Popular posts from this blog

A personal journey through the captivating landscape of Bengali literature

Cashmere: Soft, luxurious, sought-after

January Blues